Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ভাষা ও সংস্কৃতি

যাত্রা গানঃ

যাত্রা গানের ইতিহাসে ঝালকাঠির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পঞ্চাশের শতকেও পশ্চিম বাংলার তথ্য এ দেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মুখে উচ্চারিত হতো নট্ট
কোম্পানীর যাত্রা গানের কথা। এ নট্ট কোম্পানী ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশার পাঁজিপুঁথিপাড়া গ্রামের বাবু শশীভূষণ নট্ট এবং তার ভাই হারান চন্দ্র নট্ট
প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন অবিভক্ত  বাংলার শ্রেষ্ট  যাত্রা দল নট্ট  কোম্পানী। তখন  সামাজিক বেড়াজাল  পেরিয়ে মহিলারা যাত্রা পালায় অংশ নিতে পারতেন
না। সে কারণে মহিলা চরিত্রে ছেলেদের দিয়ে অভিনয় করানো হতো। শিল্পসম্মত অভিনয়, কাহিনী বিন্যাস ও বিবেকের গান বেশির ভাগ ঐতিহাসিক ও সামাজিক
কাহিনী  নিয়েই রচিত হতো। প্রথম দিকে যাত্রাপালার শুভ যাত্রা শুরু হয় জমিদার বাড়ীর অভ্যন্তরীণ আঙ্গিনায়। এর পর নট্ট কোম্পানী ঝালকাঠি সদরসহ দেশের
বিভিন্ন শহর বন্দরে  যাত্রা পালা করে অল্পদিনেই বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এরপর কোলকাতাসহ পশ্চিম বাংলার প্রায় সর্বত্র যাত্রা পালা করে নট্ট কোম্পানী  অচিরেই
শ্রেষ্ট যাত্রা দলের স্বীকৃতি লাভ করে। যাত্রা দলের প্রতিষ্ঠাতা শশী ভূষণ নট্টর পুত্র হীরণ নট্ট। পিতা পুত্র উভয়ই ছিলেন সারা বাংলার শ্রেষ্ট তবলচিদের অন্যতম।
দেশ স্বাধীন হবার পরে হীরণ নট্ট দেশে চলে আসেন। ১৯৮৫ সনের ১৬ মার্চ দেশের বাড়ীতে পাঁজিপুথিপাড়াতেই তার মৃত্যু হয়। হীরণ নট্টের যোগ্যপুত্র পতিত
কুমার নট্ট এতদাঞ্চলের শ্রেষ্ট তবলচি

পালাগানঃ

পালাগান লোক সংস্কৃতির আর একটি অন্যতম আকর্ষণ। পোনাবালিয়ার অপরুপ সুন্দরী আয়না বিবি পালাগান গেয়ে বরিশালসহ আশপাশের জেলাগুলোতে
খ্যাতি অর্জন করেন। আয়না বিবির সৌন্দর্য ও কন্ঠ মাধুর্যে আকৃষ্ঠ হয়ে তাকে ভাষাণ পালাগানের সম্রাজ্ঞী উপাধী দিয়েছিলেন শিল্পানুরাগীরা। পরবর্তীকালে
দুটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি পালাগানের সৃষ্টি হয়েছিল, গুনাই বিবির পালা ও আসমান সিং এর পালা। যার প্রচার সর্বজনবিদিত

গুনাই বিবিঃ

গুনাই বিবির পালা একটি সত্য ঘটনাশ্রয়ী। ব্রিটিশ শাসনামলে ঝালকাঠির বর্ধিষ্ণু ও সমৃদ্ধ নবগ্রাম এলাকায় গুনাই ও তোতার প্রেম
পরিনয়ের কাহিনী রচিত হয়। গ্রাম্য কবিয়ালরা হাটে হাটে সুর করে এ কবিতা পড়ে শ্রোতাদের কাছে এ কবিতার বই বিক্রি করতেন।
এ কাহিনী  নিয়ে পর্যায়ক্রমে রচিত হয়েছে পালাগান, যাত্রাপালা ও লোকনাট্য। এ  কাহিনীর সবগুলোই সংগীত প্রধান। এর মধ্যে
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গোলাম মোস্তফা মাসুমের গুনাই বিবি, ডাঃ চারুচন্দ্র রায়ের আসল গুনাই বিবি ও তোতা মিয়া, এ,কে,এম,
শহীদুল হকের গুনাই বিবি এবং ডঃ বিপ্লব বালার লোকনাট্য গুনাই বিবি। তবে প্রত্যক রচয়িতাই কাহিনীর নাটকীয় মুহুর্তগুলোর জন্য
যে গান ব্যবহার করেছেন তা প্রায় সব একই ধরনের গান ।

গুনাই বিবির সংক্ষিপ্ত কাহিনীঃ

গ্রামের সম্ভ্রান্ত  গাজী পরিবারের আদরের সুন্দরী মেয়ে গুনাই বিবি। পিতৃহীন গুনাই বিবি ছিল ভাই রফিকের আদরের নয়নমনি। অন্যদিকে লম্পট ও
অসৎজমিদার দুলু মিয়ার  ভাই লাল মিয়ার পূত্র তোতা মিয়া। লাল মিয়ার মৃত্যুর সময়  ৯ লক্ষ টাকাসহ নাবালক তোতা মিয়াকে তুলে দেন ভাই দুলু
মিয়ার  হাতে।শর্ত থাকে যে, তোতা মিয়া সাবালক হলে ৯ লক্ষ টাকাসহ জমিদারী ফেরৎ দেওয়া হবে তাকে। সুন্দরী গুনাই বিবির সাথে স্কুলে পরিচয়
ঘটে তোতা মিয়ার।পরস্পরের প্রতি দুজনে আকৃষ্ট হলেও সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে  কারো পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব হয় নাই। অপর দিকে
ঘরে সুন্দরী স্ত্রী ও সন্তান থাকা সত্যেও গুনাইকে বিয়ে করতে চায় তোতার লম্পট চাচা দুলু। রফিকের আদরের বোন গুনাইকে লম্পট ও ভাইয়ের ছেলের
জমিদারী আত্মসাৎকারী দুলুরকাছে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। দুলু ডাক্তারের সহায়তায় ঔষধের সাথে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে রফিককে মেরে ফেলে।
অবশেষে রফিকের ভাই খালেকেরপ্রচেষ্টায়  গুনাই তোতার বিয়ে সম্পন্ন হয়। তোতার লম্পট চাচা দুলু ক্ষিপ্ত হয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তোতাকে সরিয়ে দিয়ে |
গুনাইকে পাওয়ার জন্য গোপনে চেষ্টা চালাতে থাকে। তোতার নির্দেশে দীঘির পাড়ের বকুল গাছ কাটতে গিয়ে গাছের নিচে চাপা পড়ে  প্রাণ হারায় মানিক
নামের ঐ গ্রামের এক যুবক। গ্রামের কিছু লোক ও পুলিশের  সহায়তায় মানিকের হত্যার দায় চাপিয়ে  দিয়ে তোতাকে বরিশাল  জেল হাজতে পাঠিয়ে
দেয়। এ সুযোগে দুলু মিয়া গুনাইকে পাবার জন্যে নানা পন্থায় প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু গুনাইয়ের পতি প্রেমের কাছে তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
অবশেষে নানা দুঃখ কষ্টের মধ্যে বরিশালের এক দয়ালুআইনজীবির সহায়তায় আইনী লড়াইয়ে তোতা মিয়া মামলা থেকে অব্যাহতি পায়। মামলার রায়ে
তোতা মিয়া ৯ লক্ষ টাকাসহ জমিদারী ও ফেরৎ পায়। সে সাথে গুনাই বিবিও তোতা মিয়ার পুণর্মিলন ঘটে। মিথ্যা রিপোর্ট দেয়ার দায়ে দারোগাকে চাকুরী
হারিয়ে  জেলে যেতে হয়েছিল।  এই হচ্ছে  গুনাই বিবি ও তোতা মিয়ার অমর প্রেমের কাহিনী। শোনা যায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পির কন্ঠে শুনাই বিবির পালা গান
গ্রোমোফোনে রেকর্ড করা হয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো এ গানগুলো।

আশমান সিংহঃ

ঝালকাঠি জেলার আরেকটি হ্নদয় বিদারক সতাশ্রয়ী কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে আশমান সিং এর কাহিনী। এ কাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে  কবিতা, পুঁথি,
পালাগান ও লোকনৃত্য। দক্ষিণাঞ্চলের মগ জলদস্যুদের দমন করতে  সুগন্দা নদীর উত্তরে  নলছিটি থানার অন্তর্গত  সুজাবাদের কিল্লা স্থাপনা এ সূত্রেই গ্রামের
নাম হয় সুজাবাদ। মগ জলদস্যুদের সংগে যারা যুদ্ধে নিহত  হয়েছিলেন তাদেরকে মোঘল সম্রাজ্যের পক্ষ থেকে শাহ সুজা এ এলাকায় লাখেরাজ সম্পত্তি দান
করেছিলেন। সে সূত্রে আশমান সিং এর পরিবার এ লাখেরাজ সম্পত্তি হিসেবে লাভ করেছিলেন সুজাবাদ গ্রামটি। একই গ্রামের লোকমান সিং এর মেয়ে রায়
দূর্গা নামে এক পরমা সুন্দরীর সাথে আশমান সিং পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। আর্থিক অনটনের কারণে আশমান সিং অধিকাংশ সময় নলছিটি বন্দরে এক
ইংরেজ ব্যবসায়ীর কাছে থাকতেন। আশমান সিং এর এ অনুপন্থিতির সুযোগে পার্শ্ববর্তী  গ্রামের খোদানেওয়াজ খাঁর সংগে  দূর্গার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে।
খোদা নেওয়াজ খাঁর পূর্ব পুরুষরাও ছিলেন শাহ সুজার সৈন্যদলের সদস্য। শিকারের নাম করে খোদানেওয়াজ খাঁ প্রায়ই দূর্গার বাড়িতে যেতেন। কিছুদিন
পর দুর্গার একটি কন্যা সন্তান হয়। আশমান সিং এ খবর জানতে পেরে একদিন গভীর রাতে বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। দুর্গা টের পেয়ে পিছনের  দরজা
দিয়ে নেওয়াজকে পালিয়ে যেতে সাহাযা করে। ঘরে ঢুকে আশমান সিংহ তরবারি দিয়ে দূর্গাকে আক্র্রমন করলে দূর্গা কন্যা সন্তানকে আশমান সিং শেষ পর্যন্ত
ভিক্ষাবৃত্তি করে দুর্গাকে পেট চালাতে হয়েছিল। অবশেষে মানসিক যন্ত্রণায় পাগল হয়ে দুর্গার শেষ পরিণতি ঘটে। এ সত্যাশ্রয়ী ঘটনা নিয়ে অনেক কবিতা, পুঁথি,
যাত্রাপালা ও গান রচিত হয়। বাংলা ১৩৭৪ সনের ৩১ শ্রাবণ শিক্ষক সেকান্দার আলী সিকদার আশমান সিং এর কাহিনী বরিশালের কোরআন মঞ্জিল থেকে
প্রথম প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে পল্লী কবি জসিমউদ্দিন আশমান সিং এর উপর গ্রন্থ রচনা করেন- যা ১৯৮৬ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিক
সিরাজ উদ্দিন আহম্মেদও তার বরিশালের  ইতিহাস গ্রন্থে  আশমান সিং এর বিখ্যাত লোক কাহিনী  ও পুঁথির কথা উল্লেখ করেন। এ কাহিনীর উপর ভিত্তি
করে কিছু গান ও পুঁথি বরিশাল বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন  সময় প্রচারিত হয়েছে। সুজাবাদ  গ্রামের  বাসিন্দা  প্রখ্যাত  বেতার শিল্পী  আবদুর রব মাঝি
এ অঞ্চলের আঞ্চলিক গানসহ আশমান সিং এর পালা গান ঢাকা ও খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে দীর্ঘদিন নিয়মিত পরিবেশন করেছেন

বিয়ের গানঃ

বাংলা লোক সংস্কৃতির মুল্যবান সম্পদ হয়লাগান বা বিয়ের গান। ঝালকাঠির মত দেশের বিভিন্ন  অঞ্চলেও হয়লাগান প্রচলিত ছিল। গায়ে হলুদ, কনে
সাজানো, বরের আগমন ও বন্ধুবান্ধবসহ বরের বৈঠকস্থল পর্যন্ত অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এ আঞ্চলিক গানগুলো। গ্রামের অক্ষরবিহীন মহিলারা এ গানগুলো
গাইতেন। পরবর্তীতে অর্ধ শিক্ষিত মহিলারাও এ সকল হয়লাগানে অংশ নিতেন। ষাটের দশকেও ঢাকার বাংলা ছায়াছবিতে বিয়ের গান সংযোজিত হয়েছিল।
তবে গানগুলোর মধ্যে দু একটি গান বাদে বাকী গান ঝালকাঠি অঞ্চলের। ষাটের দশকেও বিয়ের প্রস্তুতি লগ্ল থেকে শুরু করে বর কনে বিদায় মুহুর্ত পর্যন্ত
আনন্দবেদনা মিশ্রিত এ সব গান খুবই জনপ্রিয় ছিল।

জারীগান

সমগ্র দক্ষিণ বাংলায় জারীগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। জারীগানের পাগল এতদাঞ্চলের মানুষ। জারীগানের কথা শুনলে আবাল বৃদ্ধবনিতা ছুটে চলে জারীগানের আসরে।
জারী গানের অপ্রতিদন্ধি গায়ক জারী সম্রাট আবদুল গনি বয়াতীর জন্ম ঝালকাঠি জেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের নুরুল্লাপুর গ্রামে বাংলা ১৩১৬ সনের ২
বৈশাখ। দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকায় আবদুল গণি রয়াতীর নাম সাতচল্লিশ এুমিকে অবন্থিত। আবদুল গণি বয়াতী গ্রায় এক হাজার গান রচনা
করে গেছেন। এছাড়াও তিনি রচনা করেছেন অসংখা জারীপালার কাহিনী। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ইসমাঈলের কোরানী, কাছেম ছকিনা, কারবালা
কাহিনী, হানিফার জন্ম ও রাধা কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী। স্বাধীনতার পৃর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের  গভর্ণর  আজম খান আবদুল গনি বয়াতীকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার
প্রদান করেন এবং জারী সম্রাট উপাধীতে ভূষিত করেন। এ মরমি শিল্পী  বাংলা ১৩৮৫ সনের ১৯ আগস্ট  নিজ বাড়ী নুরুল্লাপুরে পরলোক গমন করেন । আবদুল
গনি বয়াতীর উত্তরসুরী হিসেবে তার ছেলে বারেক বয়াতী, আবদুল হক বয়াতী, চুন্নু বিশ্বাস দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে  জারী গান গেয়ে বাবার স্মৃতি ধরে
রেখেছেন। আবদুল হক বয়াতী বরিশাল  বেতার  কেন্দ্র  থেকে বিভিন্ন  বিষয়ে নিয়মিত জারীগান পরিবেশন করে থাকেন। বাবার স্মৃতি সংরক্ষণের  উদ্দেশ্যে
তার ছেলেরা তাদের বাড়ীতে একটি সংগ্রহশালা স্থাপন করেন। বয়াতীরব্যবহ্নত জিনিসপত্র, রচনা বলি ও জারি সংক্রান্ত বই পুস্তক সংগ্রহশালায়  সংরক্ষিত আছে।
অর্থনৈতিক  সংকটের কারণে ও সংস্কারের অভাবে  সংগ্রহশালাটি হয়তবা  অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। প্রবীন বোদ্ধা দর্শক শ্রোতাদের কাছে এখনও শোনা
যায় এ কিংবদন্তী রূপকথার জারীসম্রাট আবদুল গনি বয়াতীর  জারীগান পরিবেশনের কথা। পাঞ্জাবী পায়জামা পরিহিত কাঁধে ঝুলানো থাকত হলুদ রঙের তুষের
চাদর। মঞ্চে এসে বসে চোখ বুঝে সৃষ্টি কর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতেন। এরপর শুরু করতেন জারীগান। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে ভোরের আযান অবধি চলত
এ জারীগান।  জনশ্রুতি আছে দর্শক  শ্রোতারা তন্ময় হয়ে যেতেন আবদুল গতি বয়াতীর জারীগান শুনতে শুনতে।

পুঁথি পাঠঃ

বাংলা লোক সাহিত্য সম্পদের অন্যতম পুঁথি সাহিত্য। সাধারণত মুসলমান পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা ঘরে বসে ঘটনাবহুল সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ বিভিন্ন ঐতিহাসিক
ঘটনা নিয়ে রচিত পুঁথি পাঠ করতেন। এ সব পুঁথির মধ্যে ছিলঃ হাতেমতাই, গাজীকালু চম্পাবতি, ইউসুফ জুলেখা, ইসমাইলের কোরবানী, সোনাবানের পুঁথি,
সাইফুল মুল্লুক বদিউজ্জামান ও বিষাদ সিন্ধু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সব পুঁথি পাঠের সময় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গায় গ্রামের সকল পরিবারের মহিলা পুরুষ
এসে ভিড় করতেন। গ্রাম গঞ্জের পুঁথি পাঠের প্রবীন শিল্পীদের অনেক কদর ছিল। এ সব পুঁথিপাঠ শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মোঃ আলম, আকবর আলী, আবদুর
রশিদ বয়াতী ও হাসেম বয়াতীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লেখিত পুথিপাঠ শিল্পীরা কেউ আজ আর বেঁচে নেই। দক্ষিণাঞ্চলের সংস্কৃতির তীর্থভূমি এ
ঝালকাঠিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য লোকজ সংস্কৃতি, যেমন মনসামঙ্গল, রয়ানীগান, গাজনগান।

ঝালকাঠির নাট্যাঙ্গনঃ

ষাটের দশকে ঝালকাঠির সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সকলের শ্রদ্ধাভাজন শান্তিরঞ্জন পাল প্রতিষ্ঠা করেন ঝালকাঠি শিল্পী সংসদ। তার কুমারপট্টিস্থ বাস ভবনের একটি
অংশে এর কার্যক্রম শুরু হয়। শিল্পী সংসদের নাটকে অভিনয় করতেন মোশারেফ হোসেন (প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান ঝালকাঠি পৌরসভা), রাধাকান্তনাথ,
সামশুল ইসলাম চাঁদ (সাংবাদিক), নিতাই লাল দত্ত (ব্যাংকার), সুরেশ স্বর্ণকার, বেলায়েত হোসেন (প্রাক্তন চেয়ারম্যান, ঝালকাঠি পৌরসভা), নাট্যকার এম,এ,
ওয়াজেদ, দেলোয়ার হোসেন মল্লিক (অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক বাংলাদেশ বেতার খুলনা ), মনোয়ার হোসেন খান (প্রাক্তন সাংবাদিক), চিত্তরঞ্জন (সাংবাদিক),
পূর্ণচন্দ্র মন্ডল, শান্তি রঞ্জন পাল (২), ননী গোপাল দত্ত, পার্থ সারথী দাস (শিক্ষক), মোঃ হানিফ মিয়া (সচিব, ঝালকাঠি শিল্প বণিক সমিতি), এম,এ,খালেক,
দুলাল শাহা প্রমুখ। শিল্পী সংসদদের মঞ্চায়িত নাটকের মধ্যে কল্যাণ মিত্রের বৌদির বিয়ে , কুয়াশা কান্না, সাগর সেচা মানিক, ডাঃ নিহার রঞ্জন গুপ্তের  হসপিটাল,
চক্রী। ঐতিহাসিক সিরাজউদৌলা, টিপু সুলতান, সম্রাট শাহজাহান বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। ষাটের দশক থেকে পঁচাত্তরের পূর্ব পর্যন্ত মনোয়ার হোসেন খান ও
চিত্তরঞ্জন  দত্ত অত্যন্ত  দাপটের সাথে নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি তাদের স্বরোচিত নকশা  ঐ সময়ের  প্রেক্ষাপটে সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের উপর কৌতুক
অভিনয় করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এছাড়া প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মঞ্চসজ্জা ও তাদের জুড়ির পারদর্শিতার কথা প্রবীনদের এখনো স্মরণ করিয়ে
দেয়। শান্তি রঞ্জন পাল ছিলেন নাট্যকার, পরিচালক, শিল্প নির্দেশক, প্রমটারসহ সর্বগুনে গুনান্বিত  ব্যক্তিত্ব। পঁচাত্তরের পরে তিনি কোলকাতা চলে গেলে এ
ঐতিহ্যবাহী শিল্পী সংসদের কর্মকান্ড শেষ হয়ে যায়। এর পর ৭০ এর দশক থেকে ৮০ এর দশক পর্যন্ত উদায়ন সংসদ, কাকলি সংসদ, ঝংকার, শিল্পী পরিষদসহ
বেশ কয়েকটি নাট্য সংন্থার নাম উল্লেখযোগ্য। এ সকল নাট্যঙ্গনে জড়িত ছিলেন আনোয়ার হোসেন খান (দুলু), মোসতফা  কামাল খান, হাকিম মিয়া , শাহাবুদ্দিন
আহমেদ, নারায়ন সাহাসহ আরো অনেকে ।

নাট্যগোষ্ঠীঃ

প্রতীক নাট্যগোষ্ঠী ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী নাট্য সংগঠন। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটারের সদস্য সৃষ্টিশীল ও সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ।
১৯৮৩ সনের ৩১ মার্চ প্রতীক নাট্যগোষ্ঠী ঝালকাঠির টাউন হলের একটি ভাঙ্গা প্রকোষ্ঠে  যাত্রা শুরু করে । এ পর্যন্ত  তারা ২৬ টি মঞ্চ নাটক  ও ১০ টি পথ

নাটক মঞ্চস্থ করেছে। প্রতীক ঝালকাঠি অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া  লোক সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ গ্রাম্য  পালাগানগুলোকে সংগ্রহ করে তা  লোকনাট্য  রুপ দিয়ে
মঞ্চস্থ করেছে। ইতোমধ্যে তারা গুনাইবিবি আসমান সিংহসহ বেশ কয়েকটি লোকনাট্য মঞ্চস্থ করেছে। প্রতীকের নেতৃত্বে আছেন নাট্যকার, গীতিকার, আবৃতিকার
ও নির্দেশক সুভাষদাস, আমীন আল রশিদ, আদনান বাবু, আবুল হোসেন মিলু (প্রয়াত), মহাদেব কর্মকার ও কাজী শফিকুল ইসলাম এর সাথে আরও জড়িত আছেন
মাসুদ ইমরান, আতিকুল ইসলাম, পলাশ, বাবলু, আবদুল রারেক, সজীব, অমিত, রাকেশ, রিফাত, আসিফ, কলি, মনিকা , বিথি ও মনিরা। পরবর্তীতে প্রতীককে
অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে আরও বেশ কয়েকটি নাট্য সংগঠন। তাদের মধ্যে কিশোর থিয়েটার, নটননন্দন থিয়েটার, লোকনাথ থিয়েটার। অল্প সময়ের মধ্যে
এ সকল নাট্য সংগঠনগুলো  বেশ কিছু নাটক মঞ্চস্থ করে  দর্শক শ্রোতার প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ।

সত্তর থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত যে সকল প্রবীণ শিল্পীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আজকের ঝালকাঠির সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং জনপ্রিয়তা  পায় 
তাদের মধ্যে নিরুন্নাহার নিরু (বেতার শিল্পী), মাহাবুব হোসেন খান খোকন (বেতার ও টেলিভিশন  শিল্পী), ওস্তাদ দেবেন  দাস (প্রয়াত), কল্পনা সাহা, ওস্তাদ
কাদের মিয়া (প্রয়াত), পতিত কুমার নট্ট (বেতার শিল্পী) ওস্তাদ গণেশ বাবু, দুলাল নাথ। গীতিকারদের গানগুলোর অধিকাংশ সুর করেছেন মাহবুব হোসেন খান
খোকন, ইকবাল হোসেন আন্টু ও মোঃ রফিক। গানগুলো এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে, কবি সামশুর রহমান, আসাদ চৌধুরী ও ইত্তেফাকের সম্পাদক, কথা সাহিত্যিক
রাহাত খান ঝালকাঠির এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গানগুলোর উচ্ছাসিত প্রশংসা করেছিলেন। এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছেন ঝালকাঠি সংগীতাংগনের অভিজ্ঞ
শিক্ষকমন্ডলী। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলেন বীনা রায়, পতীত কুমার নট্ট,মনির হোসেন মিন্টু, মোঃ রফিক, শিপ্রা রানী দাস ও নজরুল ইসলাম। এদের প্রচেষ্টায়
অনেক ছাত্রছাত্রী শিক্ষা লাভ করে এ গানগুলোকে পুনরায় শ্রোতাদের সামনে নিয়ে এসেছে।বর্তমানে ঝালকাঠিতে সাংস্কৃতি চর্চায় বেশ গতিময়তা ফিরে এসেছে একথা
নিবির্ধায় বলা যেতে পারে। এ প্রজন্মের বেশ কিছু তরুণ কন্ঠ শিল্পী আঞ্চলিক সংগীতসহ বিভিন্ন সংগীতের ধারাকে ধরে রাখতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঝালকাঠিতে
কোন আগন্তুক এলে শুনতে পাবেন ভোরে ও সন্ধ্যায় শহরের প্রায় বাড়িতেই  ছেলেমেয়েরা হারমোনিয়োমে গলা সাদছে। কেউবা ভোরে ভৈরবী রাগে ও সন্ধায় ইমন
রাগে রেওয়াজ করছেন। নববই এর দশক থেকে ঝালকাঠিতে অনেক সংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে।  এদের মধ্যে উত্তরণ শিল্পীগোষ্ঠী, উদিচি শিল্পী গোষ্ঠী,
অংগীকার শিল্পী গোষ্ঠি, রুপসী বাংলা, কলতান, নজরুল একাডেমী, কিশলয় খেলাঘর, আকাশপাড়ী খেলাঘর, শিল্পী পরিষদ, প্রান্তিক সংগীত একাডেমী, আববাস
উদ্দিন একাডেমী উল্লেখযোগ্য। এসব প্রতিষ্ঠানে অংগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন মনির হোসেন মিন্টু, মোঃ রফিক, নিশাত আফরিন টুম্পা, শামছুজ্জামান হিরু, শ্রাবণী,
ডলি, পলি, সামতা, সন্দীপ, শাহানা আক্তার নিপা, আনিকা, জামিনী  ও স্বর্ণসহ আরো অনেক শিল্পী। এখানে আরও একজন গুনিব্যক্তির কথা স্মরণ করতেই হয়।
তিনি হচ্ছেন এ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন কবির। তিনি ৮০ দশক থেকে অংগীকার শিল্পীগোষ্ঠীর একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সংগঠনকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি নাট্যকার, গীতিকার, মঞ্চশিল্পী ও একজন দক্ষ সংগঠক।